সমুদ্র কল্যাণের —

 সমুদ্র কল্যাণের —

জে. হোসেন.




কল্যাণ একটি সংস্কৃত শব্দ যা– সম্পদ, সুখ, সমৃদ্ধি, সুস্থতা এবং ভাগ্য অর্থে প্রকাশিত। শব্দটি একটি গুণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে এবং সাধারণত মঙ্গল কামনায় এর প্রয়োগ।


ভাষা ব্যবহার করতে জানা প্রাণীদের ক্ষেত্রে শব্দের প্রভাব অপরিসীম। অনুভূতির প্রকাশে শুধুমাত্র একটি শব্দের ব্যবহারও উদ্দীপনা কিংবা অনুধাবন সৃষ্টি করতে সক্ষম। কল্যাণ ঐতিহ্যের দিক থেকে সম্পদ, সুখ এবং শান্তি সূচিত শব্দ—প্রকৃতি পরম কল্যাণকামী।



সঙ্গীতের একটি সুন্দরতম বৈশিষ্ট্য হলো অনুভূতির দলবদ্ধকরন, হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তারই প্রকাশে ঠাটের উদ্ভব। প্রধান দশটি মৌলিক ঠাটের একটি কল্যাণ। এটি ইমনের নামেও পরিচিত, যা এই ঠাট থেকে উদ্ভুত একটি গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় রাগ।


কল্যাণ ঠাটটি কোমল গান্ধার এবং নিষাদ স্বরগুলোর ব্যবহারে চিত্রিত, এর সাথে শুদ্ধ ঋষভ, কিঞ্চিৎ কড়া মধ্যম এবং শুভ্র ধৈবত স্বরগুলো ব্যবহারে সজ্জিত। সুর সমুদ্রের এই ঠাট সংযোগে শুদ্ধ ও শ্যাম কল্যাণ, ইমন কল্যাণ, ভূপালী, কেদার, হিন্দোল, ছায়ানটের মতো বহু রাগের সুর প্রবাহ বইছে।


কল্যাণ ঠাটের ইতিহাস মুঘল সাম্রাজ্যের সংস্কৃতির মূলধারা সম্রাট আকবরের সময়কার। জানামতে 

এই ঠাটটি হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিত্ব মিয়া তানসেন সংস্কার করেন।


কল্যাণ ঠাটে অন্তর্ভুক্ত প্রভাবশালী সংগীত সংকলন এর মধ্যে উল্লেখ করা যেতে পারে– উস্তাদ 'বাড়ে গুলাম আলী খান সাহেব এর "এ রি আলি পিয়া বিন", 'পণ্ডিত ভীমসেন জোশী'র "জগত জননী", বা 'পন্ডিত জসরাজ এর "ভবানী দয়নী"। এই ঠাট থেকে উদ্ভূত রাগ ইমন কল্যাণ বলাবাহুল্য ব্যবহৃত হয়েছে, শাস্ত্রীয় থেকে আধুনিক ও চলচ্চিত্র থেকে চন্দ্রাবতী রাতের আড্ডা সঙ্গীতের চিত্রপট ইমনে অলংকৃত। 


কল্যাণ সাধারনত সকাল এবং আনন্দ, ভক্তি এবং শান্তির ভাবনা জাগ্রত করে। সন্ধ্যার সমুদ্রও কল্যাণের জোয়ার আনে। কল্যাণ একটি পঞ্চম রাগ, অর্থাৎ তার স্কেলে কেবলমাত্র পাঁচটি স্বরের ব্যবহার বাহুল্যতা পরিলক্ষিত– ন্, র, গ, ম', ধ, এবং পা, সা সুরের বিলাসিতায় কল্যাণ একইসাথে কোমল ঋষভ (রে) এবং শুদ্ধ ধৈইত (ধ) ব্যবহার করে প্রেমে অনন্য বিরহী। 


কল্যাণী ইমন, গজলে বহুলস্বীকৃত একটি রাগ– এর বৈশিষ্ট্য হলো মধ্যম সুরের ব্যবহার, যা অন্যান্য কল্যাণ রাগে বিশিষ্টতা পায় না। ইমন কল্যাণ কখনও ভৈরব কল্যাণ নামেও পরিচিত, কারণ এটি কল্যাণ এবং ভৈরব রাগের সমন্বয় বলে মনে ধরে।


গজল একটি কবিতা রচনার ধারা যার আরবী কবিতা থেকে উৎপত্তি হয়ে পারস্য সাহিত্যে বয়ে, উর্দু, হিন্দি এবং অন্যান্য ভাষাতে প্রচলিত হয়েছে। গজল রাইমিং পুনরাবৃত্তি দিয়ে সৌন্দর্য্যমন্ডিত– শব্দার্থে সৌন্দর্য; প্রেম, লঙ্ঘন, উদ্বেলনা এবং বিমূর্ত কবিতায় শ্রোতামনের মাদকতা। প্রতিটি কবিতায় কমপক্ষে একটি রাগের স্ট্রাকচার বা আবেগী সুরের মোলবন্ধন গজলে ব্যবহৃত হয়। প্রেমের উপাখ্যান গজলে অতুলনীয়। 


ইমান কল্যাণ ব্যবহারের একটি জনপ্রিয় উদাহরণ হল ফায়েজ আহমেদ ফায়েজ এর গজল "গুলন মেইন রাঙ ভারে"। এই গজলে, ফায়েজ হারানো ভালবাসার উপর ভিন্নমূলক মনোভাব সৃষ্টি করতে ইমান কল্যাণ ব্যবহার করেন।


গুলন মেইন রঙ ভরে, বাদ-এ-নূ'বাহার চালে'

চালে' ভী আও-কে গুলশন কা কারোবার চালে।


প্রতিটি খন্ড কবিতায়, ফায়েজ দ্বিতীয় লাইন পুনরাবৃত্তি করেন, এবং ইমন কল্যাণ এর সুর ব্যবহার করে একটি ভীষণ মেলোডি সৃষ্টি করেন যা কবিতার কথার খোঁজপাতায় মাতাল আবেগ উপস্থাপন করে। মেহেদী হাসান খানের কন্ঠে প্রেয়সীকে ফিরে ডাকার আবেদন, প্রেমিক হৃদয়ের অপূর্ণতার পরিপূর্ণতা সৃষ্টিতে অনবদ্য। 


ইমন কল্যাণ এর ব্যবহার গজলে মির্জা গালিব, মীর তাকি মীর, আল-এ-রাজা, এহসান দানিস, ফারহাত শেহজাদ, জাভেদ আখতার এবং ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ সহ বিখ্যাত কবির প্রচুর ক্লাসিক গজলে শুনতে পাওয়া যায়। জগজিৎ জ্বী'র কন্ঠে তুম ইতনা যো মুসকুরা'রাহেহো– শুনে কে না পুলকিত হয়েছেন! 


বাংলা গজল ধারার গানগুলির মধ্যে উস্তাদ নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর,

"আজ এই বৃষ্টির কন্না দেখে 

মনে পড়লো তোমায়– অশ্রু ভরা দুটি চোখ

তুমি ব্যাথার কাজল মেখে লুকিয়েছিলে ওই মুখ"

গানটি প্রেমিক হৃদয়ে বিনা মেঘে বৃষ্টি ঝরিয়ে দিতে পারে। 


গজলে কল্যাণ ব্যবহার করে সঙ্গীতকারগন শক্তিশালী অনুভূতির আবহ তৈরী করেন, যা প্রেমাবেগের পাশাপাশি দুঃখ, কামনা, নোস্টালজি বা মেলানকলির মনোভাব তৈরি করে। এই রাগের স্বর এবং মেলোডিক গঠন ব্যবহার করে কবিরা তাদের কবিতার ভাব আবহের প্রগাঢ়তা প্রকাশ করতে পারে এবং শ্রবণ ক্ষম প্রানীকূলের সাথে গভীর সম্পর্ক তৈরি করতে পারেন।


Comments

Popular posts from this blog

JYOTIRMOY CHAKRABORTY | TABLA PLAYER | MONON | OBOKOLPO

DIPALOK BISWAS (SITARIST) | MONON | OBOKOLPO